নৃশংসতার সৌধ
চতুর্থ পর্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের ইহূদীনিধন এখনও ইউরোপের এক দগদগে ঘা । সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এই নৃশংতার প্রভাব এবং অভিঘাত প্রতিনিয়ত বোঝা যায় । ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু বলে জাতি হিসেবে জার্মানির দায় সবচেয়ে বেশি এবং সেজন্যই এমনকি আজকের জার্মানিও যেন ৭৫ বছর আগের সেই নির্মমতার জন্য প্রতিনিয়ত অনুশোচনা করে যাচ্ছে । এমন ঘটনা আবার যেন কখনও না ঘটে, আবার কেউ যেন কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে এমন কোন নৃশংসতায় মেতে উঠতে না পারে, সেজন্য জার্মান জাতি, সমাজব্যবস্থা প্রচন্ড সাবধান । বিভিন্নভাবে অন্ধকার সেই সময়টা তাই ওরা একে অন্যকে মনে করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত, যেন ভুলে গিয়ে আবার একই ভুল না করা হয় ।
বার্লিনের বিখ্যাত ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটের ঠিক পাশেই একসময় যেখান দিয়ে কূখ্যাত 'বার্লিন ওয়াল' গিয়েছিল কিংবা তারও আগে 'হিটলারের প্রশাসনিক সদরদপ্তর' যেখাটায় ছিল, ঠিক সেখানটাতেই তৈরী হয়েছে 'Memorial to the Murdered Jews of Europe' কিংবা 'ইউরোপের খুন হওয়া ইহুদীদের স্মৃতিসৌধ' । নামে স্মৃতিসৌধ হলেও এখানে কোনও সৌধ কিংবা স্মৃতির মিনার নেই বরং পুরো প্যাটার্নটাই একটু অদ্ভুত ! প্রথমে দেখলে মনে হবে কবরস্থান হয়ত । ব্লকের পর ব্লক গাঢ় ধুসর কঠিন পাথরের সারি । কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই । কোথাও উঁচু উঁচু আবার কোথাও নিচু । ভেতরে গোলকধাঁধার মত পথ - হাঁটতে গেলে ঢেউয়ের মত কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু ! সবমিলিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরী করে, সাথে মন খারাপ করা একটা অনুভূতি । বিখ্যাত আমেরিকান স্থপতি 'পিটার আইজেনম্যান' এর ডিজাইনে তৈরী করা এই স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যও ঠিক এটাই ! প্রাণহীন কঠিন পাথর মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও মানুষের নৃশংসতার কথা, আর এর উঁচু-নিচু গোলকধাঁধা অনুভব করায় কিভাবে একটা গোটা সভ্য জাতি একজন মানুষের কথার গোলকধাঁধায় পরে এমন নৃশংসতায় সমর্থন যুগিয়েছে, অংশ নিয়েছে ! এই মেমোরিয়ালের অবস্থানটি এখানে করার আরেকটি কারণ হচ্ছে জায়গাটি জার্মানীর সংসদভবন 'রাইস্ট্যাগ' এর সভাকক্ষ থেকে দেখা যায় । উদ্দেশ্য যেন নির্বাচিত আইনপ্রণেতারা একবারের জন্যেও ভুলে না যান যে তাঁদের নীতিগত ভুল পৃথিবীর বুকে কি নৃশংসতার জন্ম দিয়েছিল !
প্রতিদিন অসংখ্য ট্যুরিস্টের আনাগোনা বলে জায়গাটা খুব বেশী একটা পরিষ্কার বলা যাবে না । তবে আমরা আমাদের পরিচ্ছন্নতাটুকু অন্ত:ত বজার রাখব - সেটিই কাম্য ।
ব্র্যান্ডনবার্গ গেট থেকে হেঁটে হেঁটে যখন স্মৃতিসৌধে গেলাম তখন বার্লিন সকালের পরিষ্কার রোদে ঝকমক করছে । কিন্তু সেই উজ্জ্বলতার ভেতরেও যেন কালো পাথরগুলোতে কি এক অন্ধকার জেঁকে বসে আছে চীরকালের জন্য । শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে ৬০ লক্ষ জ্বলজ্যান্ত মানুষকে কিভাবে গুলি করে, বোমা মেরে, না খাইয়ে রেখে, বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে একে একে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় তা এখনও আমার মাথায় ঢোকে না ! ধর্ম মানুষকে সভ্য-মানবিক-ন্যায়পরায়ণ করার কথা । কিন্তু এই ধর্মকেই ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ একে অন্যকে অবলীলায় হত্যা করে চলছে ! জনপদের পর জনপদ, সভ্যতার পর সভ্যতা ধ্বংস করে চলছে । কবে এই মূর্খতা, এই নৃশংসতা শেষ হবে কিংবা পৃথিবী ধ্বংশ হবার আগে আদৌ কি কখনও শেষ হবে ? কে জানে !
.
(চলবে)
.
চতুর্থ পর্ব: নৃশংসতার সৌধ
পঞ্চম পর্ব: কর্তৃত্ববাদী এক ধূসর বিল্ডিং
.
.
#Berlin
#Germany
#TravelStory
#পথের_গল্প
Written Byগালিব বিন মোহাম্মাদ



0 Comments