কর্তৃত্ববাদী এক ধূসর বিল্ডিং
পঞ্চম পর্ব
১৯৩৫ সাল । সদ্য চ্যান্সেলারের দায়িত্ব পেয়ে 'এ্যাডলফ্ হিটলার' তখন এক নতুন জার্মানী বানাবার নেশায় মত্ত । বিশাল বিশাল বিল্ডিং, বড় বড় রাস্তা-ব্রীজ-বাগান বানাবার মহাযজ্ঞ চলছে পুরো জার্মানী জুড়ে । আর দক্ষযজ্ঞের কেন্দ্রে রয়েছে 'বার্লিন' । হিটলারের স্বপ্নের রাজধানী 'বার্লিন'।
.
তাই বার্লিনের সবকিছুই হতে হবে বিশেষ, বিশাল, অসাধারণ, অবাক করার মত ! ইউরোপের বাকী দেশগুলো যেন হা করে চেয়ে থাকে বার্লিনের বিশেষত্ব, বার্লিনের বিশালত্বের দিকে ! হিটলারের আদেশে ডিজাইন করা হলো এমনই বিশাল-বিশেষ এক অফিস বিল্ডিং । সত্যিই সে এক এলাহী কারবারই বটে ! ১২ লক্ষ স্কয়ার ফিট ! ২,৮০০ রুম, ৪,০০০ জানালা এবং ৭ কিলোমিটার করিডরের দৈর্ঘ্য ! এটি ছিল তখনকার পুরো ইউরোপের সবচেয়ে বিশাল অফিস বিল্ডিং ! অথচ, আশ্চর্য ব্যপার হচ্ছে এই বিশাল বিল্ডিংখানা তৈরী করতে সময় লেগেছিল মাত্র ১৮ মাস ! ভাবা যায় !! জার্মান যান্ত্রিক এফিসিয়েন্সী কি আর এমনি এমনিই বলে ?!?
.
কাজ শেষ হবার পর এখানেই বসে হিটলারের বিমান বাহিনী 'লুফ্টওয়াফ' (Luftwaffe) এর সদর দপ্তর । কুখ্যাত নাৎসি নেতা এবং হিটলারের খুব কাছের লোক 'হার্মান গোয়েরিং' ছিলেন এর সর্বময় কর্তা । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লুট হওয়া দূষ্প্রাপ্য় সমস্ত চিত্রকলা এবং ভাষ্কর্যের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ ছিল এই গোয়েরিং এর কাছেই । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে এই লুফ্টওয়াফই ছিল হিটলারের তুরুপের তাস । তাঁর পুরো Blitzkrieg বা 'বিদ্যুৎগতির আঘাত' এর পরিকল্পনাই ছিল এই বিমান বাহিনী বা লুফ্টওয়াফের উপরে নির্ভর করে । হিটলারের ফ্রান্স দখল সহ যুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরের প্রায় সবকটি বিজয়ই এসেছিল তার ব্লিটৎক্রিগ স্ট্র্যাটেজির সফল প্রয়োগের মাধ্যমে, যার মূলে ছিল লুফ্টওয়াফ; আর একটা বিশ্বযুদ্ধ চালাবার এই পুরো কার্যক্রমই চালানো হতো এই বিল্ডিংটি থেকে !
.
তবে মজার ব্যপার হচ্ছে 'ভার্সাই চুক্তি' হিসেবে জার্মানির পক্ষে কোন সামরিক বিমান বাহিনী রাখার অনুমতি ছিল না । তাই পুরো বিষয়টিই রাখা হয়েছিল সম্পূর্ণ গোপন । কভার হিসেবে বলা হতে এটি জার্মানির বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের অফিস, যারা কিনা সাধারণ যাত্রী এবং বেসামারিক মালামাল পরিবহন করে । চিন্তা করে দেখুন নাৎসি প্রোপাগান্ডা মেশিন কি অসম্ভব ক্ষমতাবান ছিল যে একটা পুরো বাহিনীর অস্তিত্ত্বই ঢেকে রেখেছিল কি সফল ভাবে, এমনকি পুরো একটা যুদ্ধ চলার সময়েও ! মিত্র বাহিনীর চোখেও তাই এই বিল্ডিংটি ছিল একখানা বেসামরিক স্থাপনামাত্র। তাই বার্লিন পতনের সময়েরও তারা এর উপর কোন বিমান হামলা করে নি । বরং, বিমান হামলা এড়াতে বার্লিন যখন ব্লাক আউট করত, তখন উপর থেকে মিত্রবাহিনীর বৈমানিকরা এই বিল্ডিং দেখে বুঝতে পারত যে তারা বার্লিনে পৌঁছেছে ! তারপর শুরু হত বোমা বর্ষণ ! অর্থাৎ, বিল্ডিংটি এক অর্থে হিটলারের ঘরের শত্রু বিভিষনও ছিল ! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ! অনেকটা যেন "তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।"
.
বার্লিন পতনের পর সোভিয়েত বাহিনী যখন শহর দখল করে নেয়, তখন তাঁরা আবিষ্কার করে এই বিল্ডিংখানাই হচ্ছে আসলে নাৎসি লুফ্টওয়াফের হেড কোয়ার্টার ! তাঁদের তখন নিজের চুল ছেড়ার মত অবস্থা ! কেন এটিকে এত বছর ধ্বংস করেনি !
.
পরবর্তিতে এই বিল্ডিংকে ঘিরেই গেড়ে বসে কম্যুনিস্ট সোভিয়েত শাসন । এটিই ছিল সোভিয়েত শাসনের মূল সদর দপ্তর । গুপ্তচর বৃত্তি, টর্চার সেন্টার সহ ঠান্ডা যুদ্ধের অসংখ্য কলকাঠিই নাড়া হত ধূসর রংয়ের এই বিশালাকার এই বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন রুম থেকে । তখনও বার্লিনবাসীর কাছে এই বিল্ডিংটি ছিল এক রক্ত ঠান্ডা করা আতংকের নাম ।
.
ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল সকালে হেঁটে হেঁটে বিখ্যাত 'ব্র্যান্ডেনবার্গ গেইট' থেকে 'ইউরোপের খুন হওয়া ইহুদীদের স্মৃতিসৌধ' পার হয়ে 'উইহেমস্ট্রস' এ্যাভিনিউর পাশ ঘিরে নিরব দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংখানি যখন চোখে পড়ল প্রথম দেখাতেই একটা ধাক্কার মত লাগল । প্রকান্ড জানালা, মোটা ক্রসবারের শিক, প্রকান্ড উঁচু সিলিং, ধুসর রংয়ের লাইমস্টোনের স্ট্রাকচার… … … সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে এটি কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের একখানা জমকালো সিম্বলের মতই লাগছিল । বিল্ডিংখানা যেন এখনও চিৎকার করে ধমকি দিচ্ছে "বাধ্য নাগরিকের মত আমার কাছে মাথা নত কর, নইলে তোমার রক্ষা নাই ।" অদ্ভুদ এক অনুভুতি ! বিল্ডিংখানা এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত নয় । তাই ভেতরে গিয়ে ছবি তোলার সুযোগ ছিল না । আর এই জাঁকালো স্থাপনার অনুভূতিটুকু কোনওভাবেই ক্যামেরার লেন্সে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় । তাই ছবি তোলায় মনোযোগ ছিল না । ইট-কাঠ-পাথরের স্থাপনাও কি ভীষণ রকম জীবন্ত আর সিম্বলিক হতে পারে তা এই বিল্ডিংখানার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে না দেখলে ঠিক অনুভব করা যায় না । নিজেদের মতবাদ মানুষের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে দেবার নাৎসিদের এই কৌশল সত্যিই ঈর্ষনীয় ! তাই তো এত বছর পার হয়ে গেলেও দেশে দেশে অনেক একনায়কই এখনও কর্তৃত্ববাদীতা ফুটিয়ে তোলার এই কৌশল এখনও প্রয়োগ করে যাচ্ছে । তবে সেটিতে শেষ পর্যন্ত গদী রক্ষা হচ্ছে কি না - সেটি বরাবরের মতই এখনও প্রশ্নসাপেক্ষ ।
.
সাথে ছিল গাইড ‘এ্যানী’ । আমেরিকান । বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী । ক্লাস রুম থেকে এক বছরের জন্য ছুটি নিয়ে জার্মানিতে এসেছে হাতে কলমে ইতিহাস জানতে । গাইডের কাজ করে হাত খরচ যোগায় আবার একই সাথে ইতিহাসটাও জানা হয়ে যায় । এ্যানী বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল "এই বিল্ডিংটা তৈরীর পর থেকেই এখন পর্যন্ত সবসময়ই মানুষের জন্য ভীতিকর হয়েই আছে । প্রথমে ছিল নাৎসী বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর, তারপর সোভিয়েত শাসনকেন্দ্র । এমন কি এখনও এই বিল্ডিংকে জার্মানরা ভয় পায় । পারলে এড়িয়ে চলে ।"
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম "আগে ভয় পাবার কারণটি না হয় বুঝলাম । কিন্তু এখন মানুষ একে ভয় করে কেন ? জন-বান্ধব জার্মানীতে এখানে এখন কিসের অফিস আছে ?"
"আভ্যন্তরীন অর্থ-বিভাগ অর্থাৎ ইনকাম ট্যাক্সের সদর দপ্তর ! হা হা হা !!" এ্যানী হাসতে হাসতে জবাব দিল !
.
.
(চলবে)
.
প্রথম পর্ব: ছুটি-ছুটির শহরে
দ্বিতীয় পর্ব: শান্তির দরজা
তৃতীয় পর্ব: রাইস্ট্যাগের আগুণ
চতুর্থ পর্ব: নৃশংসতার সৌধ
.
.
.
#Berlin
#Germany
#TravelStory
#পথের_গল্প
Written Byগালিব বিন মোহাম্মাদ



0 Comments