
প্রথম পাহাড় ভ্রমণ
রাঙামাটি ভ্রমণ
আমি চট্টগ্রাম, বান্দরবান,সিলেট, খাগড়াছড়ি, সাজেক ভ্রমণ করেছি, দার্জিলিং গিয়েছি, পুরো শিলং চেরাপুঞ্জি ঘুরেছি, নেপালের পোখারা থেকে নাগরকোট, ধুলিখেল চষে বেড়িয়েছি , গ্যাংটিন হাইল্যান্ড এর বিশাল পাহাড়ের উপর দিয়ে কেবল কারে ঘুরেছি, লংকাবি র পাহাড়ের উপর স্কাইব্রীজ ঘুরেছি। দেখেছি ফুকেটের সমুদ্রের ভিতরে গজিয়ে উঠা বিশাল বিশাল পাহাড়, কুনমিংয়ের স্টোন ফরেস্ট এর কিম্ভুতকিমাকার পাথরের পাহাড় । প্রতিটি ই তার নিজস্ব রুপে অপরুপ । প্রত্যেক টা ভ্রমণের আবেদন ই আমার কাছে অতুলনীয়। কিন্তু প্রথম সেই রাঙামাটি র পাহাড় ভ্রমণে যে ভয় ভয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি, ধ্যান মগ্ন পাহাড় গুলো দেখে বুকের ভেতরে যে উথাল পাথাল হয়েছিল সে রকম টি আর হয়নি। আসলে প্রথম তো প্রথম ই।
আমি ভাই সমতলের মানুষ, পাহাড় পর্বতের কথা শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়েছি। বুদ্ধদেবের বই পড়তাম আর কল্পনায় গল্পের পাত্র পাত্রী র সাথে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে পাহাড় জংগলে ঘুরে বেড়াতাম।
আমার বিয়ের বয়স মাত্র ১৫ দিন, কক্সবাজার গিয়েছি মধুচন্দ্রিমা য়। যাওয়ার পথে চাচা শ্বশুরের ( শ্বশুরের মামাতো ভাই) বাসায় (চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট চাচা এম ই এস এর ইঞ্জিনিয়ার ) একরাত থেকে কক্স বাজার গেলাম যাওয়ার সময় চাচা কথা আদায় করে রাখলো যে ফেরার পথে তার বাসায় দুই দিন থাকতে হবে সে আর চাচী আমাদেরকে নিয়ে রাঙামাটি, কাপ্তাই, পতেংগা,ফয়েজ লেক বেড়াবে। চাচা আর তার ভাতিজা বয়সে প্রায় সমান তাই তুইতোকারি সম্পর্ক। চাচা বছর দুই আগে বিয়ে করেছে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কোথাও বেড়ানো হয়নি। যে কথা সেই কাজ। আমরা যাবো প্রথমে বাসে করে রাঙামাটি। ওখান থেকে কাপ্তাই, কাপ্তাই থেকে বাসায়।আমি আর চাচী দুই জন ই সালোয়ার কামিজ পরেছি। আমি যখনকার কথা বলছি তখন বিয়ের পর মেয়েদের শাড়ি পড়তে হতো। আমার নতুন বিয়ে হওয়ায় শাড়ি বেশি নেই তাই সালোয়ার কামিজ ভরসা। তো চাচীকে দেখে চাচা বল্লেন কি ব্যাপার তোমাদের দুই জন কে তো একেবারে ছেড়ি ছেড়ি ( অবিবাহিত অল্প বয়স্ক মেয়েদের আমাদের এলাকায় ছেড়ি বলে।) লাগতেছে। কেউ দেখলে কি মনে করবে?
চাচী একগাল হেঁসে বললো কোন অসুবিধা নাই কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি চাচা কে দেখিয়ে বলবো আমি আমার চাচার সাথে বেড়াতে এসেছি আর চাচী তোমাকে দেখিয়ে বলবে সে ও তার চাচার সাথে বেড়াতে এসেছে। চাচীর কথা শুনে আমরা সবাই খুব হেঁসে ছিলাম। আজ চাচা, চাচী, চাচার ভাতিজা কেউ ই বেঁচে নেই কিন্তু এই লেখাটি লিখতে গিয়ে চাচীর সেই হাসির শব্দ এখনো কানে বাজছে। চোখের কোন ভিজে উঠছে। বড় অসময়ে এই তিনজন চলে গেছে আর কালের সাক্ষি হয়ে আমি বেঁচে আছি।
খুব সকাল বেলা বাসে রওনা দিলাম, বাস বললে ভুল হবে আসলে বাস না মুড়ির টিন। কিছু দূর যাওয়ার পর ই শুরু হলো সেই ভয়ংকর রাস্তা। একদিকে খাড়া পাহাড় অন্য দিকে গভীর খাঁদ। আর রাস্তা গুলি সেইরকম চিকন, কোনরকমে একটা গাড়ি যেতে পারে। আতংক নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছি এই বুঝি বিপরীত দিক থেকে আর একটা গাড়ি চলে আসলো। বাস যখন কো কো করে উপরের দিকে উঠে আর ভয়ানক বাঁক গুলো ঘুরে তখন মনে হয় আমি শুন্যে ভেসে আছি বাস এখুনি পড়ে যাবে। পাহাড় দেখবো কি খাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। আমি বললাম যাবো না ফিরে চলো। (সে আমার হাত ধরে চোখের ইশারায় বললো ভয় পেয়ো না আমি তো আছি।) কিন্তু তখন আর ফিরে আসার ও কোন উপায় নাই। যত দোয়া দরুদ জানা আছে চোখ বন্ধ করে সব পড়তে লাগলাম। বাস থেকে নেমে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম এই রাস্তা ছাড়া বাসায় যাওয়ার অন্য কোন রাস্তা নেই?
চাচা হেসে বললো চাচী এই রাস্তা দিয়ে আর যেতে হবে না আমরা নৌকায় করে কাপ্তাই যাবো আর কাপ্তাই থেকে বেবিট্যাক্সি করে বাসায় যাবো। চাচার কথা য় আশ্বস্ত বোধ করলাম। মনে র ভয় টা ও কেটে গেলো। এইবার আমি নির্ভয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছি। চারিদিকে শুধু পাহাড় মাঝ দিয়ে লেক, লেকের পানি একেবারে নীল। পাহাড়ের গা ঘেষে লেকের উপরে লম্বা লম্বা বাঁশ খুঁটি দিয়ে রাস্তা বরাবর টং ঘর। ঠিক হলো রিজার্ভ বাজার থেকে খাওয়া শেষ করে ইন্জিনচালিত নৌকা নিয়ে আমরা লেকে ঘুরবো তারপর ঐ নৌকা নিয়ে ই কাপ্তাই যাবো। হোটেল আরজু নামে একটা খাবারের হোটেলে গেলাম। চাচার ভাতিজা র নাম ও আরজু তাই চাচা ঠাট্টা করে বললো কি ভাতিজা তুমি আবার কবে এহানে আইয়া হোটেল বানাইলা?😄 আমি আর চাচী ফ্রেস হবো বলে ওয়াশরুম কোথায় জানতে চাইলে একটা ছেলে বললো আমার সাথে আসেন। আমাদের নিয়ে ছেলেটা ভিতরের দিকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। মনে হলো তিন তলা পরিমান নেমে গেলাম। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে, কেমন যেন ভয় ভয় করছে। চাচী আার আমি চাওয়া চাওয়ি করছি কিন্তু ওয়াশরুমে যাওয়া টাও জরুরী। নিচে নেমে দেখি আলো, পিছনে লেক দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি মহিলা কেউ রান্না করছে কেউ বাটনা করছে একজন মুরগী কাটছে। আমরা আশ্বস্ত হলাম। পরে বুঝেছি এখানকার সব বাড়ি ঘর গুলিই এইরকম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হবো তখন চাচী বললো আমি আদিবাসী দের ড্রেস কিনবো। আবার সেই ছেলেটি আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। তখন এখনকার মতো রিজার্ভ বাজারে কোন দোকান পাট ছিলো না। আবারও সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা এবার আর ভয় করছে না সাথে চাচা ভাতিজা দুইজন ই আছে। নিচে নেমে দেখি আদিবাসী দের ছোট্ট একটা বাড়ি একটি ঘরে একজন বসে তাঁতে কাপড় বুনছে। সেখান থেকে আমরা থামি, ওড়না, গামছা কিনেছিলাম। এবার নৌকা ভাড়া করে শুরু করলাম নৌকা যাত্রা, প্রথমে আমরা ঝুলন্ত ব্রীজ টা দেখতে গেলাম। তখন পর্যটনের মোটেল টা ছিল না। আবাসিক কোন হোটেলই ছিলো না। উঁচু উঁচু পাহাড়, একটা পাহাড়ের খাঁজ থেকে আর একটা পাহাড়ের শুরু। জীবনে প্রথম পাহাড় দেখছি। পাহাড় গুলো র কাছে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। সেই পাহাড়ের অত উঁচু তে আদিবাসী দের বসবাস। একটু পানির প্রয়োজন হলে ও ওদের নিচে নেমে আসতে হয়, কি কঠিন জীবন যাপন। আঁকা বাঁকা লেক, মনে হয় এই বোধহয় পথ শেষ কিন্তু আবার নতুন পথ। মাঝি নিয়ে গেল রাজবন বিহার, চাকমা রাজ বাড়ি। এরপর গেলাম শুভলং বাজার, কি যে অপুর্ব দৃশ্য দুপাশে পাহাড়ের সাড়ি মাঝখান দিয়ে লেক।এখানে একটা ঝর্ণা আছে কিন্তু নভেম্বরের শেষ তাই ঝর্ণা য় পানি নেই। তখন ও পেদাটিং টিং, বা টুকটুক এর জন্ম হয়নি। বাজারে উঠতে গিয়ে ই আমাদের জান যায়। কি করে যে আদিবাসী রা অত উপরে উঠে আল্লাহ ই জানে। বাজারে লেকের মাছ বিক্রি হচ্ছে, আমার জন তো বিশাল এক চিতল মাছ কিনে বসলো। চাচা খুব রাগ হলো, তোমরা চলে যাবা আমরা দুইজন মানুষ এতো বড় মাছ কে খাবে? পরে চাচী সেই মাছের কোফতা খাইয়ে ছিল।
বিঃদ্রঃ
তখন মোবাইল ছিলো না ক্যামেরায় ছবি তুলতে হতো, একটা ফিল্ম এ ৩৬ টা ছবি উঠতো হঠাৎ ২/১ টা বেশি উঠতো, সেই দূর্মুল্যের বাজারে নিজেদের ছাড়া প্রকৃতি র ছবি তুলবো সেটা ভাবাই যায় না। যদি জানতাম কোন একদিন টিওবি তে লিখবো তাহলে যত কষ্ট ই হতো বুকে পাথর চাপা দিয়ে দুই একটা পাহাড়ের ছবি নিশ্চয়ই তুলতাম। তাই সেই সময়ের পাহাড়ের কোন ছবি দিতে পারলাম না। পরবর্তী তে যে ছবি তুলেছি সেই ছবি দিলাম।
ভাই আবারও বলছি আমি লেখক নই পাঠক তাই ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
লেখাটি আমি আমার চাচা শ্বশুর, চাচী শ্বাশুড়ি, এবং তাদের ভাতিজা কে ( যে তিনজন এই ভ্রমণে আমার সংগী ছিলেন) উৎসর্গ করছি। সবাই তাদের জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাদের সবাই কে জান্নাত বাসি করেন।
সুন্দর পৃথিবী কে সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমার আপনার আমাদের সব্বার। আসুন আমরা সবাই সবসময় সেই চেষ্টা করি।
Written Byকানিজ ফাতিমা বকুল


0 Comments