
প্রথম পাহাড় ভ্রমণ
বান্দরবান ভ্রমণ
সম্ভবত ১৯৯৮ এর শেষের দিকে। বন্ধু মাসুদ আর্মি ISSB তে টিকলো ৪৩ লং কোর্সে। তখনো ট্রিট বোতলে আবদ্ধ হয় নি। বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম এই খুশিতে সবাই কক্সবাজার যাবো এবং অবশ্যই মাসুদের টাকায়। অনেক মারধরের পরে ৪০০০/ টাকা বরাদ্দ পাইছিলাম। লোকসংখ্যা ৫ জন, মাসুদ বাদে। মাসুদের বাসা দিয়ে শেষমুহূর্তে অনুমতি দেয় নি, যদি কোনো ঝামেলা হয় এই ভয়ে। অতটা উদার ছিলাম না, স্বার্থপরের মতো মাসুদকে ছাড়াই রওনা দিলাম। ট্যুর ম্যানেজার বন্ধু মহিউদ্দিন কচি(বর্তমানে ডিডি, বাংলাদেশ ব্যাংক)।
একসময় কত কম খরচে ঘুরতাম এখন ভাবলে অবাক হই! বরিশাল থেকে স্টিমারে চাঁদপুর। সারারাত ঘুম হয় নি এই ভয়ে যে স্টীমার যদি চাঁদপুর পার হয়ে চলে যায়, আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি! চাঁদপুর থেকে ট্রেনে চট্রগ্রাম। সেখান থেকে গাড়িতে কক্সবাজার। কক্সবাজারে তিনদিন এক বন্ধুর বোনের বাসায় থাকার পরে হিসাব করে দেখলাম পকেটে ফেরার ভাড়া ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু টাকা আছে। আমি, আসাদ, তানভীর সিদ্ধান্ত নিলাম বান্দরবন যাবো। বন্ধু নীরব যাবে না, ওর পেটে সমস্যা। ম্যানেজার মহিউদ্দিন কচিও যাবে না, কারণ তখনো অজানা।( পরে স্বীকার করছিল, কমন ফান্ডের টাকা ব্যাক্তিগত কেনাকাটায় খরচ করে ফেলেছিল। ওর ভয় ছিল, বান্দরবন গিয়ে টাকা শর্ট পড়লে আমরা যদি হিসাব চাই।
চট্রগ্রাম থেকে বান্দরবনের টিকিট কেটে হেলপারের সাথে যুদ্ধ করে তিনজন গাড়ির ছাদে উঠলাম। শর্ত, আর্মি চেক পোস্টের আগে ভিতরে ঢুকতে হবে। যথারীতি চেকপোস্ট পার হওয়ার পরে আবার গাড়ির ছাদে। ছাদে বসেই প্রথম সত্যিকারের পাহাড় দেখা। এইপথে ছাদে চড়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারাই বুঝবে এর মজা। গাড়ির ছাদে আতঙ্ক আর উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি। উপরে থাকতে ভয় লাগে, নীচে নামলে লজ্জা। হেলপারের সাথে অনেক ফাপর নিয়ে উপরে উঠছিলাম। দেখতে দেখতে বিকেল নাগাদ বান্দরবন পৌছেছিলাম।
উঠবো কোথায় জানি না। আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই বান্দরবন ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করতেন। কখনো উনাকে দেখি নি, শুধু নাম জানি, ঠিকানাও জানি না। যাই হোক গেটে গিয়ে নাম-পরিচয় দিয়ে, ঠিকানা আর গেটপাস নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আলো কমে আসছিলো, পাহাড়ি পথ। যাই দেখি সব ভালো লাগে, শীতের শুরু, বাইরে তেমন লোকজন নেই, নিজেদের অভিযাত্রী মনে হচ্ছিল।
রাতে ভাইয়ের সাথে কথা বলে মেঘলা, শৈলপ্রপাত আর চিম্বুক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাথে ইয়াসাকি ক্যামেরা। ফ্লিম ভাগ করা, একেকজন ১০ টা করে ছবি ভাগে পাবে। এরপর অতিরিক্ত ফ্লিম থাকলে গ্রূপ ছবি তোলা হবে।
মেঘলায় তখনো ঝুলন্ত ব্রিজ হয় নি। দড়ি টানা বোট ছিল। ট্যুরিস্ট বলতে আমরা তিনজনই ছিলাম। এখন কেমন জানি না, তখন হরিণের নেটের খাঁচা ছিল, উপরটা ফাঁকা। চারদিকে কেউ নাই, খাঁচা টপকে ভিতরে ঢুকে পড়লাম, উদ্দেশ্য হরিণ কোলে নিয়ে ছবি তুলবো। এইসুযোগ বাকি দুইজনের মিস করার প্রশ্নই আসে না। ওরাও ঢুকে পড়লো। খাঁচা একদমই ছোট তবু হরিণ ধরতে পারি নি, আসাদ বেশি চেষ্টা করতে গিয়ে আঙুল ভাঙছিলো। এরপর হাটতে হাটতে শেষ সীমানায় পৌঁছানোর একটু পরেই দেখি ৩/৪ জন লোক থামার সিগন্যাল দিতে দিতে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। বুঝলাম, সামথিং রং। খুচরা কিছু টাকা বাইরে রেখে মূল টাকা তিন ভাগ করে যে যার জায়গামতো লুকিয়ে ফেললাম।
বাকিটা করুন ইতিহাস। হরিণ চোর বলে তিনজনকে ধইরে নিয়ে গেল। একজন বলতিছে, দড়ি আন আগে বাইন্দা লই। কেউ বলতিছে হরিণের পা ভাঙছে, ১০০০০০/ টাকা তো জরিমানা হবেই। আরেকজন বললো হরিণ চুরির মামলা , ৭ বছর জেল কনফার্ম। এর ভিতরে ক্যামেরা গায়েব। টাকা সার্চ করা শেষ। তানভীরের চোখে পানি ( মেডিক্যাল পড়ুয়া ভালো ছাত্রতো, পদাধিকার বলে ভীতু), আসাদ খুচরা যে কয়টা টাকা বাইরে ছিলো তাই দিয়ে মিউচ্যুয়ালের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার বাথরুম চাপছে। এর মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো বান্দরবন কোথায় উঠছি। মনের মাধুরী মিশায়ে বললাম মেজর অমুকের বাসায়। (যদিও ভাই হাবিলদার ছিল)। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত। গাছতলা থেকে অফিসে জায়গা পাইলাম। পাকা পেঁপে আসলো, সাথে ক্যামেরা। সরি টরি বলে গাড়িতে উঠাইয়া দিলো। অনেক সময় নষ্ট হইছে। তারপরও জেলখানা থেকে মুক্তি পাইছি এইরকম আনন্দ মনে নিয়ে দুপুরে শৈলপ্রপাত রওনা দিলাম।
পানি কম ছিল, ট্যুরিস্ট একদমই ছিল না। নিচে নামতে নামতে ছবি তোলায় এতো ব্যস্ত ছিলাম যে কোথাও নিরিবিলি বসে সৌন্দর্য্য উপভোগ করার কথা মনে ছিল না। আলো কমে আসার পর মনে পড়লো, কোথাও তো বসা হয় নি! এই দুঃখে এরপরপর অনেকগুলো ট্যুরে আমরা কোনো ক্যামেরা নেই নাই।
রাস্তায় উঠে গাড়ির জন্য অপেক্ষায় আছি। এক পাহাড়ি ভাই বললো লাস্ট গাড়ি চিম্বুক দিয়ে ৫ টায় ছাড়ে ওটা চলে গেছে, এখন আর কিছু পাওয়া যাবে না। (তখনো সম্ভবত চিম্বুকের পরে গাড়ি যাওয়া শুরু করে নি)। আমরা হাটা পার্টি হাঁটা শুরু করলাম। মাত্র 8.5 কিমি! কতক্ষন আর লাগবে! পাহাড়ে কিঃমিঃ সমন্ধে ধারণা থাকলেও দুরত্ব সমন্ধে ধারণা ছিল না।
চারদিকে অদ্ভুত নির্জনতা। মনে হচ্ছিল এই পুরো পাহাড়ের মালিক আমরা। হাটতে হাটতে পাহাড়ের প্রেমে পরে গেলাম। এডভেঞ্চারে বাধা দিল তানভীর। কিছুদূর যাওয়ার পরে হাল ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লো। টেনশন শুরু। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর একটা প্রাইভেট কার দেখে স্মার্টবয় আসাদ লিফট চাইলো। সিনামেটিক স্টাইলে গাড়িটা অনেক দূরে গিয়ে আবার ব্যাক করলো। সবার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। সাথে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট; একটু জাতে উঠলাম। আমাদের ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার আগে ব্রিজের উপর নামিয়ে দিলো। উনাদের একজন ছিলেন লোকাল ওসি অন্যজন ডাক্তার, কোনো একটা প্রোগ্রাম থেকে ফিরছিলেন। পাহাড়গুলো একটু কেমন যেন, সবাইকে মনেহয় উদার বানিয়ে ফেলে। পাহাড়ে কারো সাহায্য চেয়ে পাই নি, এরকম কখনো হয় নি।
সময় ছিল না, চিম্বুক যাওয়া হয় নি।
পাহাড় সমন্ধে একটু সাহিত্য করে বললে বলা যায়, প্রথম দেখায় সমুদ্র আমাকে মুগ্ধ করলেও প্রেমটা আসলে হয়েছিল পাহাড়ের সাথে। নিজের বাড়ি থেকে কিছুদিন দূরে থাকলে ঘড় যেমন তীব্র ভাবে টানে তেমনি কিছুদিন পরপর পাহাড়ে না গেলে অস্বস্তি শুরু হয়। বউয়ের ধারণা পাহাড়ে আমাদের আরেকটা সংসার আছে। পাহাড়ের আরেকটা জিনিস খুব ভালো লাগে, সে তার সৌন্দর্য্য একটু একটু করে মেলে ধরে। যে যত গভীরে প্রবেশ করবে, তার কাছে তত বেশি সৌন্দর্য্য ধরা দেবে!
প্রতিটা পাহাড়ের আলাদা চেহারা আছে। যাদের কাছে সব পাহাড়কে একই রকম লাগে তারা পাহাড়ে বেশিদিন টিকতে পারে না।
মনে করেন আপনি নির্জন একটা পাহাড়ের খুব সুন্দর একটা ভিউ পয়েন্টে বসলেন, নিচে তাকিয়ে দেখলেন ২০/২৫ টা ওয়ান টাইম প্লেট বা বিরিয়ানীর প্যাকেট। বিশ্বাস করেন পাহাড়কে তখন আর নিজের মনে হবে না। সত্যিকারের ট্রাভেলেররা কিন্তু চিপসের প্যাকেট নিয়ে ঘোরে না। আমরা চাইলেই কিন্তু ব্যাগের একটা পকেট ফাঁকা রাখতে পারি আমাদের ফেলে দেয়া হাবিজাবির জন্য।
বলতে লজ্জা লাগে, পাহাড়ে সেই জায়গাগুলোই সবচাইতে সুন্দর , যেখানে বাঙালিদের পদচারণা তুলনামূলক কম।
Written Byমশিউর রহমান কাওসার



0 Comments