বিশুদ্ধ অক্সিজেনের দেশ ভূটান ভ্রমনের গল্প
৭ দিন ৮ রাত
বজ্র ড্রাগনের দেশ,বিশুদ্ধ অক্সিজেনের দেশ,সুখী মানুষের দেশ,কার্বন নেগেটিভ দেশে এমন হাজারো উপমা দেওয়া যাবে ভূটান কে। ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে প্রথম ট্যুর ভূটান থেকেই শুরু করবো।কিন্তু বিভিন্ন কারনে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুদিন ধরে শুনতে পাচ্ছিলাম ভূটান সরকার নাকি ২০২০ সাল থেকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য ভূটান ভ্রমনে ট্যাক্স আরোপ করতে যাচ্ছে। এটা শোনার পর থেকেই মোটামুটি ইচ্ছা ছিলো ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভূটান থেকে ঘুরে আসবো।তবে ক্লাস, এক্সাম থেকে শুরু করে সবকিছু মিলিয়ে সাহস পাচ্ছিলাম না।এমন সময় ট্যুর পার্টনার ফোন দিয়ে বললো ভূটান গেলে ডিসেম্বরের শেষেই যাবো,না হলে পরবর্তীতে আর যাওয়া হবে না। কোনকিছু চিন্তা না করেই হ্যা করে দিলাম(পকেটে কোন টাকা না থাকার স্বত্তেও)।প্লান ছিলো ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ গিয়ে ৩১ তারিখ ব্যাক করবো।কিন্তু এক্সামের কারনে সম্ভব হলো না। ততদিনে অবশ্য জেনে গিয়েছি ট্যাক্স চালু করলেও জুনের আগে করবে না,এজন্য এত প্যারা নেইনি। বাই রোডে ভূটান ভ্রমনের জন্য ইন্ডিয়ার ট্রানজিট ভিসা লাগবে।এজন্য আমরা ১৮ ডিসেম্বর ট্রানজিট ভিসার জন্য এপ্লাই করি।ট্রানজিট ভিসার পোর্ট সিলেক্ট করতে হবে চ্যাংড়াবান্ধা /জয়গাও।ইন্ডিয়ান ভিসার জন্য যে কাগজপত্র লাগে তার সাথে শুধু আপ-ডাউন বাসের টিকিটের অরিজিনাল কপি এবং ফটোকপি ও হোটেল বুকিং এর কপি লাগবে। সাধারণত ট্রানজিট ভিসা জার্নি ডেট এর আগেরদিন বা জার্নির দিন দেয়।তবে আমাদের জার্নির দিন শনিবার থাকাতে বৃহস্পতিবার ভিসা পেয়েছিলাম। আমরা আগে থেকেই গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম। ৭ দিন ও ৬ রাতের জন্য একটা হায়েস গাড়ি ঠিক করেছিলাম সাথে হোটেল( ৩ রুম)। কথা ছিলো চ্যাংড়াবান্ধা থেকে পিক করে আবার চ্যাংড়াবান্ধা ড্রপ করে দিবে। এর জন্য উনাকে আমরা '৭৯ হাজার রুপি' দিবো।এই ট্যুরের আগে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক প্যারা খেয়েছি এজন্য আগে থেকেই সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলাম।আর সবসময় তো বাজেট ট্যুর দেই এজন্য চিন্তা করলাম এবার একটু রিল্যাক্স ট্যুর দিয়ে দেখি।তবে আমি সাজেস্ট করবো আগে থেকে গাড়ি ঠিক না করে ওখানে গিয়ে করার জন্য। আমাদের ড্রাইভার এর নাম নিমা।বয়সে ইয়াং,খুব ভালো ইংলিশ বলতে পারে।খুব ভালো ও না আবার খারাপ ও না,মোটামুটি প্রফেশনাল আর কি। ৭ দিনের ট্যুরে আমাদের রুট প্লান ছিলো এমন।
ঢাকা - চ্যাংড়াবান্ধা - জয়গাও - ফুয়েন্টসলিং - থিম্পু - পুনাখা - ফোব্জিকা - চেলালা পাস - পারো - ফুয়েন্টসলিং - চ্যাংড়াবান্ধা - ঢাকা।
প্রথম রাতঃ
আমরা ৯ জনের গ্রুপ ২৯ তারিখ রাত ৮ টায় ঢাকা থেকে হানিফের নন এসি বাসে(ভাড়া ৬৫০) যাত্রা শুরু করি।দীর্ঘ ১১ ঘন্টার জার্নি শেষে সকাল ৭ টায় চ্যাংড়াবান্ধায় আসি।
প্রথম দিনঃ
বাস থেকে নেমে হানিফের কাউন্টার থেকে ফ্রেশ হয়ে বুড়ির হোটেলে নাস্তা করতে গেলাম।এই হোটেল অনেক নামকরা হলেও এদের ব্যাবহার অনেক খারাপ আর খাবার ও আহামরি কিছু না।এটা এখানকার প্রথম হোটেল,এজন্য মনেহয় নামকরা। নাস্তা শেষে হাটতে হাটতে ইমিগ্রেশন এর দিকে হেটে গেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম কোন দালাল ছাড়াই নিজেরা ইমিগ্রেশন এর কাজ করবো। কিন্তু গিয়ে বুঝলাম এখানে পুরাটাই সিন্ডিকেট। ৯ টায় বর্ডার ওপেন হওয়ার কথা থাকলেও এখানে ৮.৩০ থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। শ্যামলী কাউন্টার এর একজন কে দিয়ে আমরা ইমিগ্রেশন এর কাজ করেছিলাম, ৯ জন ২১০০ টাকা দিয়ে 😞।আপনার গন্তব্য যদি নেপাল / ভূটান হয় তাহলে দালালের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন এর কাজ করটাই ভালো হবে।না হলে লেইট হয়ে যাবে। মোটামুটি ৮.৫০ এর দিকে আমরা বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করে ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করি। ৯.১৫ এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করি,এখানে লেগেছিল জনপ্রতি ১০০ টাকা।ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষে মানি এক্সচেঞ্জ করতে গেলাম।এখানে গিয়ে দেখলাম অবস্থা আরো ভয়াবহ,পুরাটাই সিন্ডিকেট। মানি এক্সচেঞ্জ করার সময় অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে করবেন।অনেক যাচাই-বাছাই করার পর ১০০ টাকায় ৮২.২৫ রুপি ও ডলারে ৭১.৬০ রুপি করে পেয়েছিলাম।ভুটানের মুদ্রা গুলট্রাম হলেও সবখানে রুপি চলে। মানি এক্সচেঞ্জ শেষ করে আমরা গাড়ির জন্য ওয়েট করতে থাকলাম। নিমা আমাদের বলেছিলো চ্যাংড়াবান্ধা থেকে ১০ টার দিকে গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের জয়গাও নিয়ে যাবে। নিমা গাড়ি ঠিকই পাঠিয়েছিল কিন্তু বাটপার ইন্ডিয়ান ড্রাইভার আসছি আসছি করে ১২ টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখল। মেজাজ প্রচন্ডরকম খারাপ ছিলো সবার।পরে নিমাকে ফোন দিয়ে ঝাড়ি দেওয়ার পর ও বললো একটা গাড়ি ঠিক করে চলে আসতে যেটার ভাড়া সে পে করবে।অবশেষে ১২.৩০ এর দিকে ২৮০০ রুপিতে ১০ সিটের একটা গাড়ি নিয়ে জয়গাও এর দিকে রওনা হলাম। দুপুর ৩ টার দিকে আমরা জয়গাও পৌছালাম।এখন ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন থেকে এক্সিট নেওয়ার পালা।স্টার সিনেমা হলের পাশে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অবস্থিত। এখানে কোনপ্রকার টাকাপয়সা লাগে না। ইমিগ্রেশন শেষ করে SBI এর এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে হলো আরেক ঝামেলা। প্রায় প্রতিটি বুথ ই বন্ধ,যেগুলা ওপেন আছে ওইগুলাতে আবার টাকা নাই। অন্যান্য ব্যাংকের ও সেইম অবস্থা পরে অবশ্য এক্সট্রা চার্জ দিয়ে ভূটান থেকে টাকা উঠিয়েছিলাম। বিকাল ৪ টার দিকে আমরা ভূটান প্রবেশ করি। ইন্ডিয়া থেকে ভূটানে ঢুকলেই আপনি বুঝতে পারবেন ভূটান কত পরিচ্ছন্ন আর সুন্দর দেশ। কয়েক মিটারের ব্যাবধানে আবহাওয়া ও ভিন্ন মনে হবে।মোটামুটি ৫ টার মধ্যে আমরা ভূটানের ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করি।ভূটানে যাওয়ার জন্য আলাদাভাবে ভিসা নেওয়া লাগেনা,অন এরাইভাল ভিসা দেয়।এর জন্য লাগবে পাসপোর্ট এর ফটোকপি, পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি ও হোটেল বুকিং এর কপি। ফুয়েন্টসলিং থেকে থিম্পু ও পারোর পারমিশন দিবে ৭ দিনের জন্য।এর চেয়ে বেশিদিন থাকলে বা অন্য শহরে যেতে চাইলে থিম্পু থেকে পারমিশন নিতে হবে।ড্রাইভার কে বললে উনি ব্যাবস্থা করে দিবে।ইমিগ্রেশন শেষ করে ড্রাইভার এর কথামতো চলে গেলাম ১৭০ রুপির বুফে খেতে।ভেবেছিলাম সারাদিনের খাওয়া একবারে খেয়ে টাকা উসুল করে নিবো।কিন্তু ভাত নেওয়ার পর পাশে পর্ক দেখার পর খাবার খেতে পারিনি । বুদ্ধিমানের কাজ হবে ইন্ডিয়া থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আসলে। কোনরকম খাওয়া শেষ করে একটা সুপারশপ থেকে ব্রেড, জেলি ও শুকনা খাবার কিনে নিয়েছিলাম রাত ও সকালে খাবার জন্য। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে সন্ধ্যা ৬.৩০ এর দিকে থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফুয়েন্টসলিং থেকে থিম্পু এর দূরত্ব ১৫০ কিঃমিঃ এর মত সময় লাগে সাধারণত ৫.৩০-৬ ঘন্টার মতো। ফুয়েন্টসলিং থেকে যত থিম্পু দিকে যাচ্ছি শীতের পরিমাণ ও তত বেড়ে চলেছে। অবশেষে রাত ১২.৩০ এর দিকে আমরা থিম্পু পৌছালাম।নিমা আমাদের হোটেল Pemaling villa তে রেখেছিলো। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দিলাম লম্বা এক ঘুম।
খরচ=৩৯৩ টাকা +২৫০ রুপি=৬৯৫ টাকা(জনপ্রতি)।
দ্বিতীয় দিনঃ
আগের দিনের জার্নির ধকল কাটানোর জন্য একটু দেরিতে ঘুমথেকে উঠেছিলাম। মোটামুটি ১০ টার দিকে আমরা সিটি ট্যুরে বের হই। প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম 'National Memorial Chorten'। ভেতরে ঢোকার জন্য ৩০০ রুপি এন্ট্রি ফি লাগবে।আমরা ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে দেখে চলে আসি।এখান থেকে চলে আসি 'Kuensel phodrang যেটা Buddha statue নামে বেশি পরিচিত। ভূটানের সবচেয়ে বড় Buddha statue এটা।পাহাড়ের উপর বিশাল বড় বৌদ্ধ মুর্তি।এখান থেকে পাশের পাহাড়গুলাকে দেখতে অসাধারণ লাগে। এখানে আমরা ১ ঘন্টার মতো থেকে চলে আসি 'Simple Bhutan'। এটা একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম, ঢুকতে এন্ট্রি ফি লাগবে ৩০০ রুপি। আমরা ৩ জন বাদে সবাই ভেতরে গিয়েছিলো।যেহেতু আগেরদিন ভালোমতো খাওয়া হয়নি এজন্য আমরা নিমা কে বলেছিলাম আমাদের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। প্রথমদিন ভূটানি খাবার খেয়ে আর রিস্ক নিতে চাইনি। নিমা আমাদের ক্লক টাওয়ার এর পাশে Food ball নামক একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলো।এখানকার খাবার খুব ভালো, দাম ও মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে।খাওয়া শেষ করে আমরা চলে গেলাম 'Art and craft school ' Folk heritage museum ' ও Handicraft দেখতে।এই ৩ টা পাশাপাশি অবস্থিত। আরো ২/৩ প্লেস দেখার ছিলো কিন্তু আমরা ওইগুলা বাদ দিয়ে থিম্পু শহরে চলে আসি।অনেকক্ষণ থিম্পু শহর ঘুরে দেখি।সুব সুন্দর সাজানো গোছানো একটা শহর।চারিদিক এত নিরবতা, যেটা বলে বোঝানো যাবে না। থিম্পুতে Bhutan telecom থেকে B-Mobile এর একটা ট্যুরিস্ট সিম কিনে নিয়েছিলাম। পাসপোর্ট নিয়ে ছোট একটা ফর্ম পূরন করে সিম নিতে পারবেন। থিম্পু শহর ঘুরে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে আমরা হোটেলে চলে গেলাম।হোটেলে রেস্ট নিয়ে রাত ৯.৩০ এর দিকে আবার বের হলাম উদ্দেশ্য রাতের খাবার খাওয়া ও থার্টি-ফাস্ট সেলিব্রেশন করা। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আমরা আগের সেই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম।খাওয়া শেষ করে ক্লক টাওয়ারের ওখানে গিয়েছিলাম।থার্টি-ফাস্ট উপলক্ষে ছোটখাটো একটা প্রোগ্রাম চলছিলো। মোটামুটি ১ টার দিকে আমরা হোটেলে এসে ঘুম দিয়েছিলাম।
খরচ= ৪৭৫ রুপি বা ৫৭৫টাকা(জনপ্রতি)।
তৃতীয় দিনঃ
প্লান ছিলো সকাল ৮ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বো,কিন্তু লেইট হয়ে গিয়েছিলো।মোটামুটি ১০.৩০ টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য দোচুলা পাস হয়ে পুনাখা যাওয়া।থিম্পু থেকে পুনাখার দুরত্ব ৮৫ কিঃমিঃ মতো,সময় লাগে ৩-৪ ঘন্টা। থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার রাস্তাটা অনেক সুন্দর।চারিদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড় আপনাকে মুগ্ধ করবেই,সাথে বিশুদ্ধ বাতাস তো আছেই। ১২ টার দিকে আমরা দোচুলা পাস চলে আসলাম।দোচুলা পাস অনেক সুন্দর। প্রচন্ড ঠান্ডা থাকে এখানে,ভাগ্য ভালো থাকলে বরফের দেখা মিলতে পারে। দোচুলা পাস শেষ করে ১২.৪৫ এর দিকে গাড়িতে উঠে বসলাম।পথিমধ্যে নুডুলস ও থুকপা খেয়ে আবার চলতে শুরু করলাম। এই 'থুকপা' জিনিসটা না খাওয়ার চেষ্টা করবেন। দেখতে সুন্দর হলেও খেতে ভালো না। বিকাল ৩.৩০ এর দিকে আমরা চলে আসলাম বিখ্যাত পুনাখা জং এ।আগে এখানে প্রবেশ করতে ৩০০ রুপি লাগলেও নতুন বছর থেকে ৫০০ রুপি লাগে।স্টুডেন্ট আইডি কার্ড থাকলে অবশ্য হাফ।টিকিট কেটে একজন গাইডের সাহায্যে ঘুরে দেখতে থাকলাম পুনাখা জং।এটি ভূটানের দ্বিতীয় পুরাতন ও দ্বিতীয় বৃহত্তম জং।স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন এই পুনাখা জং।পুনাখা জং দেখা শেষ করে ১৫ মিনিট পায়ে হেটে চলে গেলাম সাসপেনশন ব্রিজে।ব্রিজের নিচে স্বচ্ছ নদী,চারপাশে পাহাড়া,সূর্য অস্ত যাবে যাবে ভাব।পড়ন্ত বিকালে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে? দিনের আলোতে আরো কিছুটা সময় এখানে কাটাতে পারলে হয়তো ভালো হতো। সন্ধ্যা নামার পর এখান থেকে ফিরে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমরা উঠেছিলাম হোটেল Tallpines Residency তে। ৯ টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে আশেপাশে একটু ঘুরে ঘুম দিয়েছিলাম।
খরচ = ৫৬৭ রুপি বা ৬৮৫ টাকা(জনপ্রতি)।
চতুর্থ দিনঃ
সকাল ৯ টার দিকে আমাদের একটা গ্রুপ Mo chhu & po chhu নদীতে গেল রাফটিং করতে।জনপ্রতি ১০০০ রুপি লেগেছিলো রাফটিং এর জন্য। আর আমরা কয়জন আশেপাশে ঘুরে দেখতে লাগলাম।পুনাখা অনেক নিরব আর সুন্দর জায়গা।হাটতে হাটতে চলে গেমাম Mo chhu নদীর কাছে।পাহাড়ের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত অনেক সুন্দর একটা নদী।এটা কতটা সুন্দর তা বলে বোঝাতে পারবো না।নদীর এত স্বচ্ছ পানি আমি এই প্রথম দেখলাম।ঘোরাঘুরি শেষ করে হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে ফোব্জিকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ফোব্জিকা যাওয়ার পথে আমরা গিয়েছিলাম Chhimi Lhakhang যেটা ফার্টিলিটি টেম্পল নামে বেশি পরিচিত। ফসলের মাঠের মধ্যদিয়ে কিছুদূর হেটে এই মন্দিরে যেতে হয়।আমরা অবশ্য মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করি নি। এখানে আসলে আপনি আজব আজব অনেক জিনিস দেখতে পারবেন।দুপুর ৩ টার দিকে আবার ছুটে চললাম ফোব্জিকার দিকে।অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের রাস্তাটা একটু বেশিই সুন্দর। সন্ধ্যা ৬.৩০ এর দিকে আমরা ফোব্জিকা চলে আসলাম। এখানে আমরা উঠেছিলাম Lhakpa হোমেস্টে তে।এই কয়দিনের ভেতর এখানে থেকে সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছি।রুমে ঢোকার সাথে সাথে চা,বিস্কুট ও নামকিন খেতে দিয়েছিলো। রাতে ক্যাম্প ফায়ার করেছিলাম আমরা।এখানে এসে ঢাকার কিছু ছোটভাইদের সাথে পরিচয় হয়।ওরাই প্রথম আইডিয়া দিয়েছিল সবাই মিলে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ার।শুরু করে দিলাম খিচুড়ি রান্না,সাথে ছিলো সবজি আর ডিম ভাজি।এতদিন পর আজ দেশী খাবার পেয়ে ৩ দিনের খাবার একবারে খেয়ে দিলাম। ধন্যবাদ ছোটভাই তোমাদের এত সুন্দর আইডিয়ার জন্য। খাওয়া শেষে রাতে আড্ডা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, পরদিন খুব সকালে উঠতে হবে।
খরচ= ৫৯০ রুপি বা ৭১৫ টাকা(জনপ্রতি)।
পঞ্চম দিনঃ
সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাকাতেই মন খুশিতে নেচে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে আশেপাশে ঘুরে দেখতে বের হয়ে গেলাম।চারিপাশে পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর জায়গা ফোব্জিকা ভ্যালি। ভূটানের অধিকাংশ ফসল এই ফোব্জিকা থেকে আসে। আশেপাশে ঘোরা শেষ করে গতদিন কিনে রাখা কাপ নুডুলস খেয়ে 'চেলালা পাস' এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।ফোব্জিকা থেকে চেলালা পাস এর দূরত্ব ২০০ কিঃমিঃ এর মতো,সময় লাগে সাধারণত ৬-৭ ঘন্টা।ভূটানের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা এখন চোখে পড়বে আপনার। এক মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারবেন না। বিকাল ৪.৩০ এর দিকে চেলালা পাস পৌছে গেলাম। গিয়েই দেখি স্নো ফল শুরু হয়ে গেছে ।এখানে অনেকক্ষণ বরফ বরফ খেলার পর গাড়িতে উঠে সামনে যেতে থাকলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম স্নো এর পরিমাণ বেড়েই চলেছে।এজন্য চেলালা পাস এর কিছুদূর আগে থেকেই ব্যাক করলাম। কারন স্নো এর কারনে রোড অফ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। চেলালা পাস থেকে চলে এলাম সোজা পারো সিটিতে।নিমা বলেছিল অন্য জায়গার তুলনায় এখানে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কম।এজন্য সবাই এখানথেকে শপিং করতে শুরু করলো। শপিং শেষ করে চলে গেলাম হোটেল Jiya resort এ। হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম দেওয়ার আগে দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টি দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো,কারন বৃষ্টি থাকলে তো পরদিন টাইগার নেস্টে উঠতে পারবো না।
খরচ = ৩৩০ রুপি বা ৪০০ টাকা(জনপ্রতি)।
ষষ্ঠ দিনঃ
খুব সকালে ঘুমথেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চমকে উঠলাম। দেখি আশেপাশের পাহাড় বরফে ঢেকে গেছে। আজ পুরাটা দিন রেখেছিলাম টাইগার নেস্ট এর জন্য। ভূটানের অন্যতম টুরিস্ট স্পট এই 'টাইগার নেস্ট'।এটা সমতল ভুমি থেকে ১০২৪০ ফিট উপরে অবস্থিত। টাইগার নেস্ট নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে,যা হোক সেদিকে যাবো না। অষ্টম শতাব্দীতে ৩ বছর,৩ মাস,৩ সপ্তাহ, ৩ দিন ও ৩ ঘন্টায় বানানো হয়েছে এটি। টাইগার নেস্ট এ যাওয়ার ২/৩ কিঃমিঃ আগে থেকেই দেখি প্রচন্ড স্নো ফল শুরু হয়েছে।স্নো ফল দেখে যেমন খুশি লাগছে তেমনি ভয় ও হচ্ছে।মনে হচ্ছে টাইগার নেস্টে মনেহয় উঠতে পারবো না।টাইগার নেস্টে উঠার আগে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে নুডুলস খেয়ে টাইগার নেস্টে উঠা শুরু করি।এখানে উঠার জন্য নিচথেকে ৫০ রুপি দিয়ে লাঠি ভাড়া নিতে হবে।এত বরফ আর মেঘ ছিলো যে নিচ থেকে টাইগার নেস্ট দেখা যাচ্ছিল না।কয়েকবার মনে হয়েছিলো উঠে কি করবো,টাইগার নেস্ট তো দেখতে পারবো না। বরফের কারনে রাস্তাগুলো খুব পিচ্ছিল ছিলো।এজন্য খুব সাবধানে উঠছিলাম।কিছুদূর উঠে দেখি ৬০/৭০ বছর বয়সী কিছু ইউরোপীয়ান ও আমেরিকান উঠছে।ওদের দেখে সাহস আরো বেড়ে গেলো। যত উপরের দিকে উঠতে থাকলাম তত স্নো ফল এর পরিমাণ বাড়তে থাকলো। এখানকার সৌন্দর্য আমি বলে বোঝাতে পারবো না।মোটামুটি ছোট থেকেই তো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি,তবে আজকের অভিজ্ঞতা ছিলো সবচেয়ে সেরা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনের অজান্তেই অনেকবার চিতকার করে উঠেছি।এখানে প্রকৃতির এমন রুপ দেখেছি যেগুলা আসলে চোখের দেখাতেই সুন্দর। কোন ক্যামেরা দিয়ে এগুলা বন্দি করা সম্ভব না শুধুমাত্র মনের ক্যামেরা ছাড়া।কিছুদূর উঠার পর রোদ উঠতে দেখে আরো খুশি হয়ে গেলাম। মোটামুটি ৪.৩০ ঘন্টার মধ্যে উঠে গিয়েছিলাম। উঠে ওখানে আধাঘন্টার মত থেকে আবার নামা শুরু করলাম। টাইগার নেস্টের একেবারে ভেতরে যেতে ১০০০ রুপি লাগে,আগে যেটা ৫০০ রুপি ছিলো।স্টুডেন্ট হলে হাফ। ১.৩০ ঘন্টার মধ্যে নিচে নেমে গিয়েছিলাম। এ দিনটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা দিন ছিলো ।টাইগার নেস্ট থেকে নেমে পারোতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ফুয়েন্টসলিং এর দিকে রওনা হলাম। পারো থেকে ফুয়েন্টসলিং এর দূরত্ব প্রায় ১৪০ কিঃমিঃ ,সময় লাগে ৫ ঘন্টার মতো। গাড়িতে আড্ডা আর গান গাইতে গাইতে কখন যে ফুয়েন্টসলিং চলে আসলাম বুঝতেই পারিনি।ফুয়েন্টসলিং হোটেলে থাকার কথা থাকলেও নিমা আমাদের সুবিধার জন্য ইন্ডিয়াতে হোটেল Sheetal Recidency তে নিয়ে গিয়েছিলো। এদিন রাতে নিমা আমাদের কাছথেকে বিদায় নিয়ে আবার থিম্পু চলে গেলো।
খরচ= ৪১৫ রুপি বা ৫০০ টাকা(জনপ্রতি)।
সপ্তম দিনঃ
খুব সকালে উঠে স্ট্রিট ফুড খেয়ে আশেপাশে ঘুরে দেখতে থাকলাম। ইন্ডিয়া থেকে ভূটানে ইচ্ছামত যাওয়া আসা করা যায়। আমি সকালে কয়েকবার গিয়েছি। সকাল ১০ টার দিকে ভূটান থেকে এক্সিট সিল নিয়ে ও হালকা শপিং করে হোটেলে ফিরে আসি। নিমার ঠিক করা ড্রাইভার আগে থেকেই এসে আমাদের জন্য ওয়েট করছিলো। দুপুর ১১.৩০ এর দিকে জয়গাও ইমিগ্রেশন এর কাজ শেষ করে ১২ টার দিকে চ্যাংড়াবান্ধার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। মোটামুটি ৩ টার মধ্যে চ্যাংড়াবান্ধা চলে আসি।৩.৩০ এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন এর কাজ সেরে ফেলি।এখানে কোন টাকা দেওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও জোর করে ৫০ রুপি রেখে দেয়।বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনেও টাকা চেয়েছিলো কিন্তু আমরা দেইনি।বাংলাদেশে এসে হানিফের টিকিট কেটে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। খাবার খেয়ে বাসের জন্য ওয়েট করতে থাকি।সন্ধ্যা ৬ টার দিকে বাস ছেড়ে দেয়।বাসের মধ্যে এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখি সকাল ৫ টার এর দিকে ঢাকা চলে আসছি।
খরচ=২১০ টাকা।
মোট খরচ=বাস ভাড়া ১৩০০+ ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০+৬৯৫+৫৭৫+৬৮৫+৭১৫+৪০০+৫০০+২১০+গাড়িভাড়া+ হোটেল ১০৬২০ = ১৬২০০ (জনপ্রতি)
আমাদের ভূটান ভ্রমনের ভিডিও লিংকঃ https://youtu.be/Xtii1YtQxIU
কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তাঃ
- ভূটান যেতে চাইলে চেষ্টা করবেন ৬-৯ জনের গ্রুপ করে যেতে, তাহলে খরচ কম হবে।
- ভূটানের ইমিগ্রেশন এর জন্য পাসপোর্ট এর ফটোকপি, পাসপোর্ট সাইজের ফটো ও থিম্পুর হোটেল বুকিং এর কাগজ সাথে রাখবেন।আরো কয়েক কপি অতিরিক্ত পাসপোর্ট এর ফটোকপি আর ছবিও সাথে রাখবেন।
- বর্ডার থেকে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিবেন,অন্যখানে করতে গেলে রেট কম দিবে।এটিএম থেকে টাকা তুলতে হলে চ্যাংড়াবান্ধা থেকে উঠানো ভালো।
- ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়ার চেষ্টা করবেন।হালাল হারাম নিয়ে দ্বিধা দন্দ্ব থাকলে ভেজ এর দিকে যাওয়াই উত্তম।
- প্রচন্ড ঠান্ডা মোকাবেলা করার জন্য ভারী জ্যাকেট,থার্মাল ইনার,হাতমোজা, উলের পা মোজা নিবেন।
- গাড়িতে করে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠলে বমি বমি ভাব বা মাথাব্যাথা করতে পারে।পর্যাপ্ত পরিমাণে মাথাব্যথা,বমি, গ্যাস্ট্রিক এর ঔষধ সাথে রাখবেন।
- ভূটান থেকে ফেরার সময় গুলট্রাম থাকলে ভূটানে খরচ করে আসবেন,না হলে এগুলা এক্সচেঞ্জ করতে পারবেন না।
- জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হবেন।
- কোন প্রয়োজন হলে লোকাল মানুষের হেল্প নিতে পারেন,ওরা খুব হেল্প ফুল আর মোটামুটি সবাই ইংলিশ বলতে পারে।
- টাইগার নেস্টে উঠার সময় পানি ও শুকনা খাবার সাথে নিয়ে নিবেন।ভারি ব্যাগ থাকলে নিচে রেখে যাবেন।
কিছু অনুরোধঃ কোথাও ঘুরতে গেলে এমনকিছু করবেন না যেন সেখানকার পরিবেশ নষ্ট হয়।পানির বোতল,চিপস/খাবারের প্যাকেট সহ অপচনশীল জিনিসপত্র যেখানে সেখানে ফেলবেন না,নির্ধারিত স্থানে ফেলুন।স্থানীয়দের সাথে ভাল ব্যাবহার করুন।এমনকিছু বলবেন না যাতে কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে।এমন কোন কাজ করবেন না যেন আপনার জন্য বাংলাদেশীদের বদনাম হয়।
ভূটান অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর দেশ।আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা ৭ টা দিন মনেহয় ভূটানে ই কেটেছে।এত নীরবতা,মানুষের ব্যাবহার সবকিছু আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। ৭ দিনে আমি কোন গাড়ির হর্ন এর শব্দ শুনি নি। প্রান ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহন করেছি।বেচে থাকলে খুব শীঘ্রই আবার ভূটান যাবো ইনশাআল্লাহ।
*পরিশেষে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমার ট্যুরমেটদের, যাদের জন্য আমাদের ট্যুর এত সফলভাবে শেষ হয়েছে।ধন্যবাদ তাদের যারা আমাকে আর্থিকভাবে ও বিভিন্নভাবে সাপোর্ট দিয়েছে ।
সময়ঃ ৭ দিন ৮ রাত।
খরচঃ১৬২০০(জনপ্রতি)।
এই সুন্দর পৃথিবী টা ট্রাভেলারদের জন্য।
Happy Travelling
Written Byতানভীর ফুয়াদ



0 Comments