
দেবতাখুম
বান্দরবান ভ্রমণ
এক ঘণ্টার পাথর,বালি আর অরণ্যের ঝিরিপথ ট্রেকিং শেষে আপনি যখন ভেলা নিয়ে চলতে থাকবেন সামনের দিকে, মনে হবে সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্য কতই না সুন্দর পৃথিবী তৈরি করে দিয়েছেন! দুই পাশের দুই পাহাড়ের আকাশচুম্বী পাথুরে দেয়ালের ভেতরকার গর্ত বা গুহা পথ; যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে না, নিজের মুখের কথা কিংবা চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে নিজেরই কাছে, উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে টুপ-টাপ পানি পড়ার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ বা কোলাহল নেই, বরফ-শীতল ঠাণ্ডা কিন্তু স্বচ্ছ পানির ধারা আর পাথুরে ঝর্ণা, সবমিলিয়ে নৈসর্গিক কিছু মুহুর্তের সাক্ষী হবেন আপনি!
আমরা তিন বন্ধু ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে, ৮ তারিখ ভোরে ঢাকা পৌঁছাই। ৭ তারিখ সারাদিন কাটিয়ে দিই দেবতাখুমে! সবমিলিয়ে জনপ্রতি ২১৩৬ টাকা করে খরচ হয়েছে আমাদের! খরচের হিসাব পোস্টের শেষে দেওয়া আছে।
বান্দরবান নেমে হেঁটে রোয়াংছড়ি বাস-স্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে সাঙ্গু নদীর এমন দৃশ্য পাবেন।
বর্ণনাঃ
(ঢাকা>বান্দরবান সদর>রোয়াংছড়ি>কচ্ছপতলী বাজার> শীলাবান্ধা পাড়া>দেবতাখুম)
- রাত সাড়ে দশটায় কলাবাগান থেকে গাড়িতে উঠে বান্দরবান পৌঁছাই সকাল ছয়টার দিকে। বাস কাউন্টারে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে হাঁটা ধরলাম রোয়াংছড়ি যাওয়ার বাস-স্ট্যান্ডের দিকে। এক কিলোর মত রাস্তা,সবাই অটোতে করে যায় সাধারণত। আমরা শীতের সকাল পেয়ে প্রাতঃভ্রমণ মনে করে হেঁটেই চলে গেছি!
কচ্ছপতলী বাজার,পাশেই আর্মি ক্যাম্প।এখান থেকেই ট্রেকিং শুরু হবে!
- রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে টিকিট কেটে, বাস ছাড়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে পাঁচ জনের আরো একটা গ্রুপ এসেছে দেবতাখুমের উদ্দেশ্যেই। আমরা তাদের সাথে কথা বলে একসাথে সবকিছু দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতে আমাদের গাইড খরচ অনেক কমে গেছে!
পাথর,বালি,অরণ্যের দৃষ্টিনন্দন পথ পেরুতে থাকবেন।
- রোয়াংছড়ি গিয়ে অপেক্ষারত গাইডের সাথে গিয়ে থানার পারমিশন নেওয়ার পর সিএনজি করে চলে যাই কচ্ছপতলী বাজার। সেখানে আর্মি ক্যাম্পে আবার অনুমতি নিয়ে ঝিরিপথে সকাল সাড়ে দশটার দিকে হাঁটা শুরু করি দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে।
এটাই শীলাবান্ধা পাড়া।
- ঘণ্টাখানেক পরে পৌঁছাই শীলাবান্ধা পাড়া। সেখানে হিল এডভেঞ্চার নামক হোটেলে দুপুরের খাবার অর্ডার করে ভেলা নিয়ে রওনা দেই আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে। প্রথমে নৌকা করে একটা স্টেপ পর্যন্ত গিয়ে তারপর বাঁশের ভেলায় চড়তে হয়।
- ভেলা চালিয়ে যাওয়ার পথে আমরা সাক্ষী হই প্রত্যাশার চাইতেও বেশি রোমাঞ্চের। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলার মধ্যে আমরা মিশে যাই মুহুর্তেই! স্বপ্নের মত লাগছিল সবকিছু! আমার ভেলায় থাকা আমার বন্ধুটি, ভেলা থেকে সেই অথৈ বরফ-শীতল জলে ঝাপ দিলে,স্বপ্ন ভেঙে আমিও দিলাম ঝাপ! দারুণ অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসি আড়াইটার দিকে সেই হোটেলে।
ওখানকার একমাত্র হোটেল, Hill Adventure!
- দুপুরের খাবার শেষে আমাদের গাইড ভিন্ন পথে আমাদের নিয়ে ব্যাক করতে থাকে কচ্ছপতলী বাজারের উদ্দেশ্যে। এটা উঁচু ও খাড়া পাহাড়ের মোটামুটি কঠিন আর লম্বা একটা ট্রেকিং পথ! আমরা কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিয়ে এগুতে থাকি। দুপুরের খাবারের পর যদি একটু রিলাক্সে ফিরতে চান,তবে এই পথ না ধরাই ভাল হবে! এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পাহাড়ি পথ বেঁয়ে চলে আসি কচ্ছপতলী বাজার। তারপর সেই আগের মতই ঠিক বিপরীত পথে সিএনজি করে রোয়াংছড়ি এবং রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবান শহরে পোঁছাই সন্ধ্যার একটু পরে। ঢাকার উদ্দেশ্যে টিকিট কেটে ৯.২০ এর গাড়িতে উঠে পড়ি।
শীতকালেই পাবেন এমন স্বচ্ছ, নীলাভ পানি!
খরচঃ(জনপ্রতি)
ঢাকা <--> বান্দরবান বাস ভাড়া ৬২০×২ (যাওয়া-আসা)
বান্দরবান <--> রোয়াংছড়ি বাস ভাড়া ৬০×২ (যাওয়া-আসা)
রোয়াংছড়ি <--> কচ্ছপতলী বাজার সিএনজি ভাড়া ৬০×২ (যাওয়া-আসা)
সকালের নাস্তা ৪০/-
দুপুরের খাবার ২০০/-
গাইড খরচ ১০০০ টাকা ÷ ৮ জন=১২৫/-
ভেলা ১৫০/-
মোট ১৯৯৫ + এক্সট্রা ১৪১=২১৩৬ টাকা।
দুইপাশে অনেক উঁচু পাথুরে দেয়াল আর নিচে অথৈ পানি!
কিছু কথাঃ
১. জাতীয় পরিচয়পত্রের দুইটা ফটোকপি আগে থেকেই করে নিবেন এবং ট্রেকিং এর জন্য পছন্দসই জুতা নিবেন।
২. থানা পারমিশন ও আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশনের যাবতীয় কাজ আপনার গাইডই করবে,শুধু তাকে সাহায্য করবেন।
৪. গাইড ভাড়া ১০০০ টাকা,তাই গ্রুপ যত বড় হবে খরচ তত কমবে। ভেলা ভাড়া আমরা ১০০ টাকা জনপ্রতি শুনে গেছি,কিন্তু ওখানে ১৫০/- করে লাগছে!
৫. দুপুরের খাবারের অর্ডার দিবেন ওখানকার একমাত্র হোটল Hill Adventure এ। রান্না আর খাবার আইটেম, সবই ভাল ছিল। প্রচুর খাইছি আমরা।আনলিমিটেড ছিল প্রায় সবই। রাতে আর খাওয়াই লাগে নাই,শুধু নাস্তা করছি!
৬. সাঁতার না জানলে,লাইফ জ্যাকেট পাওয়া যায় ওখানেই,নিয়ে ভেলায় উঠবেন।
৭. কচ্ছপতলী বাজার পর্যন্তই রবি/এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়! এরপর আর নেটওয়ার্ক পাবেন না!
দেবতাখুমের এই পয়েন্ট পর্যন্তই যাওয়ার অনুমতি আছে,এর পর আর যেতে দেয় না!
সতর্কতাঃ
প্লাস্টিক, পলিথিন ও অন্য কোনো বর্জ্য খুমের পানিতে তো ফেলবেনই না; যত্রতত্রও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবেন না দয়া করে। সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর অত্যাচার করে তাদেরকে রিরূপ মূর্তিমান করে তুলবেন না! মনে রাখবেন, প্রকৃতির উপর যে অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন করা হবে,প্রকৃতি তার সবটাই কিন্তু সুদে-আসলে মিটিয়ে দেবে কড়ায়গণ্ডায়!
0 Comments