সেন্টমার্টিনে চিরায়ত কুবেরের সন্ধান
সেন্টমার্টিনের মানুষ, জীবন ও জীবিকা
মাছে ভাতে বাঙালির আসল অর্থ আপনি সেন্টমার্টিনে খুঁজে পাবেন। এদের প্রধান পেশা মাছ ধরা আর প্রধান খাদ্যও মাছ। ট্যুরিস্টদের আপ্যায়নের বেলায়ও মাছের প্রাধান্য বেশি। আবার তারা মাছ রান্না ও টুরিস্টদের পছন্দের মাছ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ বৈচিত্র্য তৈরি করেছে। খাবার হোটেলগুলোকে হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ সাজানো থাকে। আপনি খেতে গেলে যেকোন মাছ পছন্দ করে দিবেন। তারা আপনাকে মাছটি ফ্রাই বা কারি করে দিবে। এছাড়াও পাবেন কাঁকড়া ফ্রাই, মাছের বারবিকিউ। সেন্টমার্টিনে যে সমস্ত মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে টুনা, চান্দা, সুন্দরি, চিংড়ি, লবস্টার উল্লেখযোগ্য। আপনি মাছ নিজে ধরেও স্থানীয় খাবার হোটেলে নিয়ে যেতে পারেন। তারা আপনাদের বিনে পয়সায় মাছ ভেজে দিবে। আতিথেয়তায় এরা অনন্য।
সেন্টমার্টিনে প্রচুর ডাব পাওয়া যায়। এখানকার স্থানীয়রা এই ডাব খেতে বিরক্ত। অফ মৌসুমে গেলে আপনি ২০-২৫ টাকার মধ্যে বড় বড় সাইজের ডাব খেতে পারবেন। যা বাংলাদেশের অন্য কোথাও বোধহয় পাওয়া যাবেনা।
সেন্টমার্টিনে ২য় দিন রাতে মাছের বারবিকিউ খাওয়ার খুব শখ হলো আমাদের। সেন্টমার্টিনের সেরা বারবিকউ মেকার (স্বঘোষিত) শুক্কুর ভাইয়ের দোকানে বসলাম। অল্প সময়ের তাড়াহুড়ায় সে মাছটির অধিকাংশই পুড়ে ফেলল। তাই তাকে সময় দিন, তার কাছে তাড়াহুড়া করে বারবিকিউ খেতে যাবেন না। আমাদের সাথে এই কারনে তার সাথে একটা মনমালিন্যের মত হয়ে গেল।
সেন্টমার্টিনের মানুষগুলো সহজ-সরল কিন্তু অল্প কারণে বিরাট ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। টুরিস্টদের ভয় পাওয়ার কারন নেই। এরা কখনো টুরিস্টদের সাথে বাধ্য না হলে ঝগড়া করেনা। শুক্কুর ভাইয়ের সমালোচনা করতেই সে রেগে গেল। আমরা কেন তাকে সময় দেই নি তাই নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত নেই। সেদিন কোনরকম খেয়ে আমরা তার দোকান থেকে বের হতেই তুমুল ঝগড়া লেগে গেল এক স্থানীয় লোকের সাথে।
ঝগড়া এদের নিত্যদিনের সাধারন ব্যাপার। শুনলাম বারবিকিউ মেকারের দুই বিয়ে। প্রথম বউকে বেশ পিঠিয়েছে বলে আর থাকেনি। হোটেলের এক ওয়েটারের সাথে কথা বলে জানা গেল ওখানকার মানুষজনও একের অধিক বিয়েতে আগ্রহী। তারা নিজেদের দ্বীপেও বিয়ে করতে চাই না। টেকনাফের কোন এক মেয়ে বিয়ে করবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।
প্রায় পরিবারে দুই একটা সন্তানের মৃত্যু ঘটে। কখনো তা চার পাঁচ পেরিয়ে যায়। হয় অসুখে নয়তো সমুদ্রের কোলে হারিয়ে যায় তারা। ওদের এখানে এটা স্বাভাবিক। ওরা একে বলে সমুদ্র জালা নিয়ে গেছে। (আঞ্চলিক)
আমরা খেয়েদেয়ে সৈকতের ধারের দোকান গুলোতে বসলাম। দোকান গুলোতে সন্ধ্যা থেকে গানের আসর বসে। এটাই ওখানকার মানুষদের বিনোদনের মাধ্যম। টিভি, বিদ্যুত বা তেমন কোন প্রযুক্তি না থাকায় গ্রামিণ লোকগান গুলো ও গানের আসর গুলো আজও টিকে আছে এখানে। এখনো তারা নির্ভেজাল গ্রামের মানুষের মত। ওদের সাথে গল্প করা, গান শুনা আর চা খেতে খেতেই একটা আড্ডা জমে উঠলো।
এই দ্বীপে ৭ জন লোক এসেছিল। এটা স্থানীয় লোকের ভাষ্য। আমরা জেনেছি এই দ্বীপে সর্বপ্রথম ১৩ পরিবার বসতি স্থাপন করেছিল। সেন্টমার্টিনের সবাই তাদেরি বংশধর। তাদের দেখানো পথে আজও তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। অবশ্য তাদের ছেলেমেয়েরা এখন লেখাপড়া শিখছে। এই সীমাহীন কষ্টের জীবন থেকে তারা একদিন মুক্তি পাবে এই তাদের প্রত্যাশা। কিছু ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেন্টমার্টিন খুব পিছিয়ে নেই। এক লোক তার মেয়েকে কক্সবাজার রেখে কলেজে পড়াশুনা করাচ্ছে। এক চায়ের দোকানের দোকানদার লালিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা দেখে মোবাইল এপে।
সূত্রঃ উইকিপেডিয়া
বর্ষার মৌসুমে প্রচুর ঈলিশ ধরা পরে এই দ্বীপে। কিন্তু তাদের ঠকিয়ে সওদাগরেরা কম দামে কিনে নিয়ে যায়। আমরা জানতে চেয়েছিলাম- টেকনাফ গিয়ে বিক্রি করতে পারেন না কেন। জেলে বললেন- আমাদের তো বড় ট্রলার নেই। আর সমুদ্র পাড়ি দিতে ভয় লাগে। দরিয়া খুব উত্তাল।
সওদাগরের জুলুম মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই জেলেদের। কার কথা যেন মনে পড়ছিল বার বার। হ্যা সে আবহমান পদ্মানদীর মাঝির কুবেরের কথা। দরিয়া পাড়ের সব মানুষের জীবন বোধহয় একি রকম। উত্তাল! ভিষণ উত্তাল!
0 Comments