সাপঃ বিপদ ও করণীয়
সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারনা রাখুন...
ভ্রমণের বিপদ!
পর্বঃ২
ভ্রমণে যাবেন আর সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে ভ্রমণ করবেন-এমনটা যদি আপনি ভেবে থাকেন তাহলে এই লেখাটা পড়ার পর আপনার চিন্তার জায়গাটা একটু হলেও স্থানচ্যূত হতে পারে।আপনি ভ্রমণ,ট্রেইলিং,হাইকিং,ক্যাম্পিং ইত্যাদি যাই করেন না কেন, এর মানেই হচ্ছে সভ্য পরিবেশ হতে নিজেকে দূরে সরিয়ে প্রকৃতির কাছে সঁপে দেয়া।আর প্রকৃতির কাছে নিজেকে যখন সমর্পণ করবেন তখন তার অন্যান্য উপাদানসমূহের ছোঁয়ায় হয়তো আপনাকে আসতেও হতে পারে।এখানে প্রকৃতির উপাদান বলতে বোঝানো হয়েছে,তার রূপ এবং তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা অন্যান্য প্রাণীসমূহকে।
এই লিখাতে বাংলাদেশের সাপেক্ষে বনে-বাদাড়ে ঘুরতে গেলে যেসব বিপদ আসতে পারে তার সারাংশ তিন পর্বে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।মনে রাখবেন,এসব বিপদ-আপদ সাধারনত ঘটে না;তবে অনিশ্চিত জীবনে যদি কখনো এরকম বিপদে পড়ে যান তাহলে আপনার জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে এ লিখাটি হয়তো কাজে আসতে পারে।
আজকে থাকছে প্রকৃতির সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর সৃষ্টি,সাপের কথা।
সাপঃ
সাপ হলো পা-ছাড়া,বুকে ভর দিয়ে চলা এক ধরনের সরীসৃপ।অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া বাকি সব মহাদেশেই এদের দেখা যায় এবং পৃথিবীজুড়ে এদের প্রায় ৩৬০০ প্রজাতির খোঁজ পাওয়া যায়।অধিকাংশ প্রজাতির সাপেরই বিষ থাকে না।আর যাদের বিষ থাকে তারা শিকার ধরতে ও আত্মরক্ষা করতে বিষের ব্যবহার করে।যেসব সাপের বিষ নেই(যেমনঃঅ্যানাকোন্ডা,পাইথন) তারা শিকারকে প্যাঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর গলাধঃকরণ করে।
বাংলাদেশে প্রায় ৯১ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায় চার ভাগের তিনভাগই নির্বিষ।
বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন কয়েকটি বিষাক্ত সাপ হলোঃ
১. দাগি ধোরা সাপ (Striped Keelback)।
২. কালনাগিনী (Ornate Flying Snake)।
৩. ইন্দো-চিনা ধারাজ সাপ (Indo-Chinese Rat Snake)।
৪. দেশি ধারাজ সাপ (Indian Rat Snake)।
৫. সবুজ ধারাজ সাপ (Green Rat Snake)।
৬. কালো পেট ধোরা সাপ(Dark-bellied Marsh Snake)।
৭. নক্সী ধোরা সাপ (Checkered Keelback)।
৮. পদ্ম গোখরো (Monocellate Cobra)।
৯. রাজ গোখরো (King Cobra)।
১০. পাহাড়ি সাপ (Mock Viper),ইত্যাদি।
সাপের কামড়ঃ
সাপ সাধারনত মানুষ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে।সাপের সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মাত্র ১৫% বিষযুক্ত এবং মানুষের মৃত্যু ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিষ ইঞ্জেক্ট করার ক্ষমতা রাখে।তাই,সাপ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞাণ না থাকলে দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ।
সাপের বিষ মোটামুটি দুই রকমঃ
১. হিমোটক্সিকঃএই বিষ রক্ত কণিকাকে আক্রমণ করে হৃদপিন্ড ব্লক করে দিয়ে ভিকটিমের মৃত্যু ঘটায়।যেমনঃচন্দ্রবোড়া সাপের বিষ হলো হিমোটক্সিক।
২. নিউরোটক্সিকঃএই বিষ মানুষের নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে।ফলে ভিকটিমের স্ট্রোক হয় এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।যেমনঃগোখরো,কেউটে এবং কালাচ সাপের বিষ নিউরোটক্সিক।
বিষক্রিয়ার লক্ষণঃ
১) দু চোখের পাতা পড়ে আসা Bilateral Ptosis (সব সাপের কামড়ের মূল লক্ষণ)
২) কামড়ের স্থানে অসম্ভব জ্বালা যন্ত্রণা (ফণাধর সাপের ক্ষেত্রে)
৩) ক্রমবর্ধমান ফোলা
৪) শরীরের নানা স্থান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসবে (চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে)
৫) ঢোঁক গিলতে অসুবিধে
৬) ঝাপসা দেখা
৭) জিভ জড়িয়ে আসা
৮) ঝিমিয়ে পড়া,ইত্যাদি।
সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
প্রাথমিক চিকিৎসা
‘RIGHT’ ফর্মুলা মাথায় রাখতে হবে৷
R(Reassurance)–রোগীকে ভয় পেতে দেয়া যাবে না।আশ্বস্ত করতে হবে।সাপের কামড়ে যে মানুষ সুস্থ হয়ে যেতে পারে এ ব্যপারে তাকে কনভিন্স করতে হবে।কোনোমতেই তাকে আতঙ্কিত হতে দেয়া যাবে না। আতঙ্কিত হলেই হার্টবিট বেড়ে যাবে এবং বিষ দ্রুত রক্তে মিশে যাবে।
I(Immobilization)–যথাসম্ভব কম নড়াচড়া করা।রোগী যত বেশি স্ট্যাবল থাকবে বিষ তত কম দ্রুত রক্তে ছড়াবে।
GH(Go to Hospital)–যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে এন্টিভেনম দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
T(Tell Doctor For Treatment)–হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারকে রোগীর চিকিৎসা করতে বলুন।রোগীর কথা জড়িয়ে আসছে কি না,হাত পা নাড়াতে পারছে কি না,নাকি সুরে কথা বলছে কি না,এসব উপসর্গ লক্ষ্য করে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
যা যা করবেন নাঃ
১. সাপের কামড়ের স্থান হতে উপরে রশি বাঁধলে আদতে কোনো লাভ হয় না,বিষ ছড়িয়ে যাবেই।তবুও ভালো করে বাঁধতে পারলে বিষ ছড়ানোর মাত্রা কমে।
২. সমীক্ষায় দেখা গেছে সাপে কাটা রোগীর মাত্র ২২% মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন।বাকীরা ওঝা,ফকির,কবিরাজ,দরবেশের নিকট গিয়ে রোগীর বারোটা বাজিয়ে ফেলেন।
৩. কেউ সিনেমার ইলিয়াস কাঞ্চন হবার চেষ্টা করবেন না।কোনো দরকার নেই চুষে চুষে বিষ বের করার।এতে কোনো লাভ হয় না বরং যিনি বিষ চুষে নেবেন তার জীবনও বিপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে।
৪. অনেকে সাপে কাটা জায়গাটা ছুড়ি দিয়ে আরেকটু কেটে রক্ত বের করে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।এটা একদমই করা যাবে না বরং আক্রান্ত স্থানটা বেশি করে পানি দিয়ে ভালো করে ধৌত করে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
সাপের কামড় থেকে বাঁচার উপায়ঃ
১) বনে-বাদাড়ে হাঁটার সময় সাথে লাঠি রাখুন।আগে লাঠি দিয়ে সামনে আঘাত করুন,তাহলে সাপ চলে যাবে।
২) রাতের বেলায় বের হলে পর্যাপ্ত আলো আর লাঠি রাখবেন।
৩)ক্যাম্পিং করলে আশেপাশে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দিয়ে সাপ থেকে দূরে থাকতে পারেন।জুতা ও জামা পড়ার আগে ভালো করে চেক করে নিতে ভুলবেন না।
৪)অনেক সাপ ছদ্মবেশী হওয়ায় সহজেই পরিবেশের সাথে মিশে যায়।তাই কোথাও হাত-পা ফেলার আগে সতর্ক থাকবেন।
সাপ বা অন্যান্য বিপদজনক প্রাণীরাও প্রকৃতির অংশ।পরিবেশের ভারসাম্য ও খাদ্য জালের সুশৃঙ্খলতা রক্ষায় প্রত্যেক প্রাণীরই স্ব স্ব ভূমিকা বিদ্যমান।তাই কোনোভাবেই তাদের কোনো ক্ষতি করা যাবে না।
0 Comments